ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। গত কয়েক দিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ইতিমধ্যে পুরো জুলাই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাকে ছাড়িয়ে গেছে চলতি সেপ্টেম্বরের প্রথম সাত দিনের হিসাব। এ মাসের প্রথম ছয় দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগেই আশঙ্কা করা হয়েছিল, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে। তাই এখনই যদি ডেঙ্গুর হটস্পট ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা করা না যায়, তাহলে ডেঙ্গু তার ভয়ংকর রূপ দেখাবে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ২৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যা চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে গত ৬ সেপ্টেম্বর এক দিনে ২৮৪ জন রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যা কি না এক দিনে সর্বোচ্চ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানাচ্ছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২৭৯ জনের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ভর্তি হয়েছেন ১৯৬ জন। বাকি ৮৩ জন ঢাকার বাইরের। আর বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৮৮৯ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ৬৭৬ জন। তাদের মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৬ হাজার ৭৫৬ জন।
তবে আগের দিন পাঁচজনের মৃত্যুর কথা জানালেও গতকাল অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু হয়নি। আগের দিন পর্যন্ত এ বছর ৩১ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে অধিদপ্তর।
এ পরিস্থিতিতেও ডেঙ্গু আসলে সে অর্থে বাড়ছে না মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘এখন রোগী ডায়াগনোসিস হচ্ছে সঠিকভাবে। আগে মানুষ হাসপাতালে যেত না। ঘরে বসে চিকিৎসা নিত। ডেঙ্গু হয়েছে কি হয়নি, তা কেউ বলতে পারত না। এখন মানুষ জ্বর হলে পরীক্ষা করাচ্ছে। এ কারণে ডেঙ্গু পজিটিভ রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে।’
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনসহ জনপ্রতিনিধিদের সাহায্যও চাইলেন অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মশাটা যদি আরও বেশি নির্মূল করা যেত, প্রজননস্থল নষ্ট করা যেত, তাহলে আরও বেশি ভালো হতো। জনপ্রিতিনিধিদের সঙ্গে তো মানুষের হৃদ্যতা বেশি। তারা যদি মানুষকে আরেকটু সচেতন করেন, সিটি করপোরেশন যদি আরেকটু জনবল দেয়, তাহলে কাজটা সহজ হয়ে যায়।’
প্রসঙ্গত, এডিস মশার মাধ্যমে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। আর বর্ষা মৌসুমে বাসাবাড়িতে জমে থাকা পানিতে এডিসের বংশবিস্তার ঘটে। দেশে প্রথম ২০০০ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বড় প্রকোপ দেখা দেয়। সে বছরে ৫ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গুতে শনাক্ত হন, আর মারা যান ৯৩ জন। এরপর থেকে ডেঙ্গু নির্মূল না হলেও ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেখা দেয়। সেবার ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জনের শনাক্ত হন, আর সরকারি হিসাবে মারা যান ১৭৯ জন। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হিসাবে এটাই সর্বোচ্চ। পরের বছরে শনাক্ত হন ২৮ হাজার ২২৯ জন, আর মারা যান ১০৫ জন।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার প্রাক-বর্ষা মৌসুমের জরিপে গত বছরের তুলনায় এ বছর রাজধানীতে মশা বেশি দেখা গেছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে আশঙ্কা ছিল, চলতি বছরে ফের ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে। এই আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না তা বোঝা যায় চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহের আলামত দেখে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের প্রথম সাত দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় দেড় হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
কন্ট্রোল রুম জানাচ্ছে, চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৩১ জনের মধ্যে জুনে ১ জন, জুলাইতে ৯ জন, আগস্টে ১১ জন আর চলতি মাসের ৬ দিনের ভেতরে মোট মারা যান ১০ জন। মারা যাওয়া ৩১ জনের মধ্যে ১৩ জন ঢাকা মহানগরের বাসিন্দা। বাকিরা ঢাকার বাইরের। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর যে হিসাব প্রতিদিন গণমাধ্যমে পাঠায় তা প্রকৃত রোগীর একটা অংশ। কারণ, কেবল ঢাকা শহরেই রয়েছে অসংখ্য হাসপাতাল-ক্লিনিক যেগুলোর হিসাব অধিদপ্তরের কাছে নেই। এসব হাসপাতাল ক্লিনিকে ভর্তি হওয়া রোগীর হিসাবও অধিদপ্তর পায় না। আবার অনেক রোগীই সাধারণ জ্বর মনে করে গলিতে থাকা ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। যার ফলে প্রকৃত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কখনোই সামনে আসবে না।